মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে জেলা প্রশাসক বরাবর ১৮ চেয়ারম্যানের স্মারকলিপি

চকরিয়ায় এক রশিতে বেঁধে মা-মেয়েকে নির্যাতন; ঘটনার চেয়ে কী রটনা বেশি!

প্রকাশিত: ১২:৪০ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ২৭, ২০২০
print news

কক্সবাজার জেলার চকরিয়া হারবাং ইউনিয়নে মা-মেয়েকে কোমরে রশি বেঁধে নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন কথা শোনা গেলেও প্রশাসনের করা তদন্ত টিম সত্য অনুসন্ধানে অনেকদুর এগিয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়।

আজ ২৬ আগষ্ট দুপুরে হারবাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিনারুল ইসলামের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে এবং গরু চুরির আলোচিত ঘটনায় হারবাং এর চেয়ারম্যান সম্পূর্ণ নির্দোষ হওয়ার পরেও তাকে জড়িত করার প্রতিবাদে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক বরাবরে চকরিয়া উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের পক্ষ থেকে স্মারকলিপি প্রদান করেন।

সে সময় সংঘটিত ঘটনার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ শামসুল তাবরীজ ও তাঁর নেতৃত্বে একটি টীম ঘটনাস্থল হারবাং পহরচাঁদা ও ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় পরিদর্শন করেছিলেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা সে সময় জানায়, চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলাম মিরান ওই দিন দুপুরে ঘটনাস্থলে না থাকলেও দ্বিতীয় পর্যায়ে পরিষদে নিয়ে গিয়ে মা-মেয়েসহ ৫ জনকেই গরু চুরির অভিযোগ তুলে মারধর করেছেন।

আরো জানা যায়, চুরি হওয়া গরুর মালিক উত্তর হারবাং বিন্দারবানখীল এলাকার নজরুল ইসলাম, জসিম উদ্দিন ও নাছির উদ্দিন মা-মেয়েকে রশিতে বেঁধেছেন। যার কারণ দেখিয়েছিলো এরা গরু চুরির সাথে সরাসরি জড়িত। পরে উপজেলার পহরচাঁদা এলাকার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মাহমুদুল হক বাদী হয়ে ওই নির্যাতিত ৫ জনকে আসামি করে চকরিয়া থানায় গরু চুরি মামলা দায়ের করেন। সেই মামলায় থানা পুলিশ আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠান।

আলোচিত এই ঘটনার খবর পেয়ে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে চকরিয়া ইউএনও দ্রুত সময়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেন। এবং স্বশরীরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে সঠিক তথ্য জানতে সাধারণ মানুষের সাথে একাধিকবার কথা বলেন।
পরে জামিনে ছাড়া পেয়ে রশি বেঁধে নির্যাতনের ঘটনায় হারবাং ইউপি চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলাম মিরানসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে চকরিয়া থানায় মামলা হয়েছে। যার থানা মামলা নং -২২। মামলায় অজ্ঞাতনামা আরো ২০/৩০ জনকে আসামী করা হয়।কয়েকজন আটকও হন। মামলার বাদী পারভিন বেগম এজাহারে উল্লেখ করেছেন, তারা রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার স্থায়ী বাসিন্দা হলেও বর্তমানে তারা স্বপরিবারে পটিয়া উপজেলার শান্তির হাট কুসুমপুরের একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করেন।

গত ২১ আগস্ট দুপুরে পারভিন বেগম তার ছেলে এমরান, ছেলের বন্ধু ছুট্টু এবং দুই মেয়ে রোজিনা আক্তার ও সেলিনা আক্তার শেলীকে নিয়ে চকরিয়া উপজেলার ডুলহাজারা ইউনিয়নের মালুমঘাটের হায়দারনাশি এলাকায় ছোট মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার সময় চকরিয়ার হারবাং পহরচাঁদা লাল ব্রিজ এলাকায় পৌঁছালে পেছন থেকে দুইটি মোটর সাইকেল নিয়ে ৬ জন লোক তাদেরকে ধাওয়া করে আটক করে এ ঘটনা ঘটান। পরে তাদেরকে কোমরে রশি বেঁধে রাস্তায় হাঁটিয়ে হারবাং ইউনিয়ন পরিষদে নিয়ে যান।

মামলার বাদী এজাহারে আরও উল্লেখ করেছেন, ইউনিয়ন পরিষদে ইউপি চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলাম মিরান তাদেরকে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করে হাতে থাকা লাঠি দিয়েও আঘাত করেন। সন্ধ্যা ৬টার দিকে ইউনিয়ন পরিষদের পাশের হারবাং পুলিশ ফাঁড়ির পুলিশ গিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তাদের উদ্ধার করে চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করান।

যদিও পারভিন বেগম জানান, গরু চুরির ঘটনা মিথ্যা ও অপবাদ। তবে মামলার এজাহার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মামলার বাদী এজাহারের কোথাও উল্লেখ করেননি যে, চেয়ারম্যান তাদের পূর্ব পরিচিত।

তাছাড়া দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হওয়া হারবাংয়ের এ ঘটনার পেছনে নারীঘটিত একটি বিষয়ও সামনে এনেছিল একটি চক্র। প্রচার করা হয়েছিল চেয়ারম্যান না-কী নির্যাতিতা পরিবারের বিবাহিত এক নারীকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এ নিয়ে বিরোধের জেরে না-কী পরিকল্পিতভাবে বর্বরতা চালানো হয়। অথচ গত মঙ্গলবার থানায় দায়ের করা মামলার আর্জিতে এই ধরনের কিছু উল্লেখ নেই! তাতে স্পষ্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে যা প্রচার হয়েছে তা নিছক গুজব আর অপপ্রচার ছাড়া কিছু নয়।

বরং অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে, দেশজুড়ে আলোচিত ঘটনার শিকার মা-মেয়েসহ সবাই চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার চিহ্নিত গরুচোর ও মাদক কারবারি। তাদের বিরুদ্ধে রাঙ্গুনিয়া থানা ও চন্দনাইশ থানায় গরু চুরির মামলা রয়েছে। পরিবারটি মাদক পাচার ও সিএনজি গাড়ি চোর চক্রের সাথে জড়িত। আদিলপুর গ্রামের লোকজন তথ্য দেন, প্রায় সময় তাদের বাড়িতে হঠাৎ গরু ছাগলের দেখা মিলতো আবার কয়েকদিন পর সেগুলো বিক্রি করে দিতো।

পাশাপাশি ঘটনার অনুসন্ধানে তথ্য পাওয়া যায়, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিরাজুল ইসলাম মিরাজের সাথে সভাপতি মিরানুল ইসলাম মিরানের দূরত্ব আর কোন্দল দীর্ঘদিনের। সভাপতি ও সম্পাদকের মধ্যে মৌখিক কথা হলেও বাস্তবে মিল নেই। যে কারণে গরু চুরির ইস্যুটি কঠোরভাবে সামনে এনে ফায়দা লুটাতে সক্রিয় চেয়ারম্যানের বিরোধীপক্ষ। কেনোনা সামনে ইউপি নির্বাচন।

চকরিয়ার লোকজন জানায়, গরু চুরির অপবাদে প্রকাশ্যে মা মেয়েকে রশিতে বেঁধে বিচারের নামে নির্যাতন ও শ্লীনতাহানি কেউ সহ্য করবে না। এলাকাবাসীরা আরো জানান, বর্তমান ইউএনও সৈয়দ সামশুল তাবরীজ একজন দক্ষ প্রশাসক। সেটি তাঁরা করোনাকালে প্রমাণ পেয়েছেন। দেশের কঠিন করোনা দূর্যোগে চকরিয়ায় তিনি যে ভূমিকা রেখেছেন তা ছিল সত্যিই প্রশংসনীয়।

তদন্ত টিম নিয়ে ঘটনাস্থলে ইউএনও তাবরীজ
গত সোমবার জেলা প্রশাসনের তদন্ত টিমের প্রধান স্থানীয় সরকারের উপ-পরিচালক (উপ-সচিব) শ্রাবস্তী রায়ের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত টিম হারবাং ইউনিয়নে ঘটে যাওয়া ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ঘটনার সময় উপস্থিত মেম্বার-চৌকিদারদের জবানবন্দি নেন। এছাড়াও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বেশ কয়েকজনের বক্তব্য নিয়েছেন। শীঘ্রই তদন্ত প্রতিবেদন জেলা প্রশাসক মহোদয়ের কাছে প্রেরণ করার কথাও জানান।

অপরদিকে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ শামসুল তাবরীজের নেতৃত্বে আরেকটি তদন্ত কমিটি মাঠে কাজ করছে। রবিবার ইউএনও সৈয়দ শামসুল তাবরীজ পূনরায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলেছেন। গঠিত কমিটির প্রতিবেদন উপর ভিত্তি করে দ্রুততম সময়ে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান।

উল্লেখ্য, গত শুক্রবার (২১ আগস্ট) চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়নে গরু চুরির অপবাদে মা-মেয়েসহ পাঁচজনকে রশি দিয়ে বেঁধে নির্যাতন করে স্থানীয় লোকজন। পরে তাদের রশি দিয়ে বেঁধে প্রকাশ্যে সড়কে ঘুরিয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলাম মিরান পরিষদে নিয়ে গিয়ে দ্বিতীয় দফায় মারধর করেন।

এছাড়াও, বৃদ্ধা মা ও তরুণী মেয়েকে কোমরে রশি বেঁধে এলাকা ঘোরানো এবং মারধর করার বিষয়ে চকরিয়া জৈষ্ট হাকিমের আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট রাজিব কুমার দেব জনস্বার্থে স্বপ্রণোদিত হয়ে হারাবাংয়ের ভাইরাল হওয়া গরু চুরির ঘটনায় একটি মামলা নিয়েছেন। উক্ত মামলাটি কক্সবাজার সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (চকরিয়া সার্কেলের) কাজী মো. মতিউল ইসলামকে পরবর্তী ৭ কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন।

ঘটনায় জড়িত ও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা নিতে ভাইরালের স্রোতে না ভেসে চকরিয়া উপজেলা প্রশাসন ও থানা পুলিশ বিষয়টির পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য যাচাই বাচাই করে তদন্তে খোঁজ নিচ্ছেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানায়।