তদন্ত কমিটি ও তদন্ত কর্মকর্তা
জটিলতার বেড়াজাল ‘সাগর-রুনির’ পথেই মেজর সিনহা হত্যা মামলা?
সাঈদুর রহমান রিমন
কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভওয়ের শামলাপুরে সংঘটিত অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যা মামলাটি কী ‘সাগর-রুনির’ মতো দুর্ভাগ্যজনক মামলায় পরিনত হতে যাচ্ছে? আলোচিত এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের গঠিত উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দাখিলে দফায় দফায় সময় প্রার্থনা এবং মামলা তদন্তকারী র্যাব কর্মকর্তা একমাসেও হত্যার মোটিভ না পাওয়ায় এমন প্রশ্নই দেখা দিয়েছে জনমনে। অনেকেই বলেছেন, সাংবাদিক দম্পত্তি সাগর-রুনির নৃশংস হত্যাকান্ডের মামলাতেও অভিন্ন স্টাইলে সময়ক্ষেপণ হয়েছে। আলামত বিনষ্ট ও মোটিভ না পাওয়ার অজুহাতে গত আট বছরেও মামলাটির চুড়ান্ত কোনো প্রতিবেদন দাখিল করা সম্ভব হয়নি। শামলাপুর চেকপোস্টে মাত্র দেড় মিনিট সময়ে সদা সতেজ দারুণ্যদীপ্ত মেজর সিনহার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেয়া হলো-অথচ এক মাসেও ঘটনার মোটিভ পর্যন্ত জানা গেল না।
তাছাড়া এ হত্যাকান্ড সংঘটিত হওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করতেই মামলার তদন্ত পারস্পারিক চাপের মুখে পড়ে, ঝুলেও যায়। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা তাকিয়ে আছেন তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের দিকে, অন্যদিকে তদন্ত কমিটির চোখ সরকারের দিকে। তদন্ত কর্মকান্ডে অভিজ্ঞজনরা হিসেব মেলাতেই পারছেন না। তারা ভরছেন, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহলো, অপরাধ, অবিচারের ঘটনা চিহ্নিত করাসহ তাদের শাস্তি নিশ্চিতকরণে বরাবরই বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের নজির রয়েছে এবং তা যথেষ্ট কার্যকরও হয়ে থাকে। কিন্তু প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের চরম ওদ্ধত্য-অবিচারের ব্যাপারে আরেকটি প্রশাসনিক কমিটি গঠনের হেতুটা কী? এ কমিটি যদি তাদের প্রতিবেদনে লিখেন যে, ‘বিদঘুটে মেজাজধারী ইন্সপেক্টর লিয়াকত সামান্যতেই অতিমাত্রায় ক্ষিপ্ত হয়ে তাৎক্ষণিকভাবেই গুলি চালিয়ে মেজর সিনহার হত্যাকান্ড সংঘটিত করেছে। ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক, অনভিপ্রেত।
ভবিষ্যতে এমন ঘটনা যাতে না ঘটে তার জন্য জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তে নিম্নোক্ত সুপারিশমালা পেশ করা হলো।’ তাহলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কী উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দ্বারা গঠিত তদন্ত কমিটিকে ওভারটেক করে ‘হত্যাকান্ডটি পরিকল্পিত এবং কতিপয় কর্মকর্তা পূর্ব আক্রোশেই মেজরের নির্মম হত্যাকান্ডটি ঘটিয়েছে’ এমন কথা উল্লেখ করে চার্জশীট প্রদানের সাহস ও ক্ষমতা রাখেন? যদি তিনি সততার সাহসকে পুঁজি করে এমন চার্জশীট দাখিলও করেন তাহলে বিচার প্রক্রিয়াটি কি অনির্দ্দিষ্টকালের জন্য ঝুলে পড়বে না? নাকি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আর তদন্ত কর্মকর্তার চার্জশীট নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করার জন্য আরেকটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নিবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়?
গলদে শুরু তদন্ত কমিটি
——————
মেজর সিনহা হত্যাকান্ডের ঘটনা তদন্তের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের বিশেষ কমিটি গঠনের শুরুতেই ছিল গলদে ভরা। ওই ঘটনার তদন্তে গত ২ আগস্ট কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহা. শাজাহান আলিকে প্রধান এবং পুলিশ সুপারের একজন প্রতিনিধি (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার) ও সেনাবাহিনীর রামু ১০ পদাতিক ডিভিশনের জিওসির একজন প্রতিনিধির সমন্বয়ে তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেখানে এসপি অফিসের প্রতিনিধি ও রামু জিওসি’র প্রতিনিধি পরিচয় চিহ্নিত করার কারণ কি ছিল? তাহলে কী সেনা ও পুলিশের মধ্যে সৃষ্ট বিরোধের জের ধরেই মেজর সিনহার নৃশংস হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে? তাহলে দেশে কী সেনাবাহিনীর সঙ্গে পুলিশের বিরোধ ছিল বা চলমান আছে? তাই যদি না হয়, তাহলে তদন্ত কমিটিতে উভয়পক্ষ থেকে একজন করে তদন্ত কমিটিতে রাখা হলো কেন? সেখানে তো সবাই থাকবেন কেবল সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ, রাজনৈতিক অধিশাখা-২ থেকে ওই তদন্ত কমিটি গঠনের মাত্র ৬ ঘণ্টার মধ্যে পূণরায় ৪ সদস্য বিশিষ্ঠ আরো শক্তিশালী কমিটি গঠন করার ঘোষণা দেয়া হয়। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব শাহে এলিদ মাইনুল আমীন স্বাক্ষরিত এই চিঠিটি মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, পুলিশ সদর দপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়। ৩ আগস্ট পুনর্গঠিত করে চার সদস্যের এ কমিটিতে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করা হয়। আর কমিটির সদস্য রাখা হয়, কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহা. শাজাহান আলি, পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এর একজন প্রতিনিধি এবং সেনাবাহিনীর রামু ১০ পদাতিক ডিভিশনের জিওসির একজন প্রতিনিধিকে। উচ্চ ক্ষমতার এ কমিটি পরবর্তী ৭ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করবেন বলেও নির্দেশ দেয়া হয়।
কিন্তু ১০ আগষ্ট এ কমিটি প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আরো সাত দিন সময় প্রার্থনা করে তদন্ত কমিটি। এবার ১৬ আগষ্ট তারা মাঠে পৌঁছে শুরু করেন দৃশ্যমাণ গণশুনানী। ফলে এবারও নির্ধারিত সময়ে প্রতিবেদন তৈরি হলো না, ফলে আরো সাত দিনের সময় নিয়ে ২৩ আগষ্ট চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য চুড়ান্ত সময় ঘোষণা করা হয়। কিন্তু আবারও অজ্ঞাত কারণে সাত দিন পিছিয়ে যায় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দাখিলে। তবে গতকালও তদন্ত কমিটির একজন সদস্য জানিয়েছেন, মেজর সিনহা হত্যাকান্ডের ঘটনায় ৬৮ জনের সাক্ষ্য ও বক্তব্য গ্রহণ করা হয়েছে। এতগুলো মানুষের বক্তব্য, অভিমত পুঙ্খানুপূঙ্খ ভাবে পর্যবেক্ষণ করে চুড়ান্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করাটা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাছাড়া তদন্ত কমিটির কাজ কেবল সিনহা হত্যাকান্ডের ঘটনাতেই সীমাবদ্ধ নয়-এ ধরনের পারস্পারিক সংঘাত, ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টির অপরাপর ঘটনাও মূল্যায়ন করে তবেই প্রতিবেদন দিতে হচ্ছে। এসব কারণে আরো এক বা একাধিক দফা সময়সীমা বাড়ানো হবে কি না তা নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো মন্তব্য করেননি ওই কমিটির সদস্য। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি সকল ক্ষেত্রেই কক্সবাজারের পুলিশ সুপার ও টেকনাফ থানা পুলিশের সার্বিক সহায়তা পাচ্ছেন। কিন্তু এর বিপরীত অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তার ক্ষেত্রে। আদালতের আদেশ না নিয়ে গেলে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে একটা সুইও দিচ্ছে না জেলা পুলিশ।
সিপ্রার পথেই সিফাতের যাত্রা
মাদক মামলায় সিপ্রা এবং তিন মামলায় সিফাত জামিন পেয়েই কয়েক মুহূর্তের জন্য সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। অন্যান্য প্রসঙ্গে সবই বলছিলেন তারা সাবলীলভাবে, কেবল সিনহা হত্যাকান্ডের বিষয় তুললেই তারা নিজেদেরকে বিপর্যস্ত বলে দাবি করে কিছু বলা থেকে বিরত থাকেন। বরং সিফাত সেদিনের নির্মম ঘটনাটির ব্যাপারে মুখ খুলতে চাইলেই সিপ্রা প্রকাশ্যেই হাত দিয়ে তাকে খোঁচা মারেন এমনকি পরনের গেঞ্জিটা টেনে ধরে মুখ বন্ধ করেন। সিফাতের দিকে এমনভাবে কটমট চাহনী দেন যে, তাতেই সে নিরব হতে বাধ্য হন। সাংবাদিক সম্মেলনে সেদিন সিপ্রার এ আচরণটি খুবই দৃষ্টিকটু হিসেবেই দেখতে পেয়েছেন দেশবাসী। এরপর থেকেই সিপ্রা-সিফাতের গতিপথ অভিন্ন হয়ে উঠে, একসঙ্গে শলা পরামর্শ করেই সময় কাটে তাদের। মেজর সিনহা হত্যাকান্ডের বিচারের চেয়েও মূখ্য হয়ে উঠে জাস্ট গো ইউটিউব চ্যানেলটি মার্কেটিং করার কাজ। তারচেয়েও গুরুত্ব পায় ওই চ্যানেলের মালিকানা নিজেদের নামে প্রচার করার কৌশলে। তবে কী জেলে থাকাবস্থাতেই সাহা আর দাসের মধ্যে গোপন সলাপরামর্শ চুড়ান্ত হয়েছে? এর জের হিসেবেই কী চতুর মেয়েটির কুটকৌশলের কাছে ধরাশায়ী হচ্ছে সিফাত?
ঘটনার রাতে টেকনাফ থানায় নিয়ে কতিপয় প্রদীপ ভক্ত পুলিশ কর্মকর্তা যা কিছু শিখিয়ে সিফাতের বক্তব্য রেকর্ড করেছিলেন-সেই শেখানো বুলি সিফাত এখনো আউড়িয়ে চলছে। কখনো কখনো আর্থিক লোভে, ক্ষমতার মোহে, আভিজাত্যে মোড়া চাকচিক্যময় জীবন যাপনের আশায় প্রধান সাক্ষী যখন ‘আসামির প্রতি বেশি মমতাবান হয়-উল্টাপাল্টা কথা বলে মামলার ক্ষতিসাধন করে’; তখন আদালতে ওই সাক্ষী কিন্তু ‘বৈরী সাক্ষী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সিফাত হয়তো সিনহা হত্যা মামলার জন্য দিন দিনই বৈরী সাক্ষীতে পরিনত হতে চলেছে। এ কারণে র্যাব তার বক্তব্য রেকর্ড করার ব্যাপারটা খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। এক কর্মকর্তা সিফাতের উদাহরণ টেনে বলেন, তার বক্তব্যটা এখন এমন যে, “মেজরকে মারাটা খুবই অন্যায় হয়েছে তবে তারও মরার দরকার ছিল।” এমন সাক্ষীকে বৈরী ঘোষণা না করে উপায় কী?
সিপ্রা-সিফাতকে উদ্দেশ্য করে নানা সন্দেহ, অবিশ্বাস, অভিযোগে ভাসছে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব। হাজারো মানুষ বিভিন্ন মন্তব্য করে চলছেন অবিরাম। বলা হচ্ছে, দেশ ও জাতী আজ শিপ্রাকে সন্দেহ করে শিপ্রা খুনিদের সাথে আতাত করে মেজর সিনহার রক্তের সাথে গাদ্দারী করছেন নাতো? কেউবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, ‘শিপ্রা দাশ এখন প্রদীপ দাশের বোন হয়ে জেল থেকে বের হয়েছে। হত্যার বিচার নিয়ে চিন্তা না করে সে নিজের লাইফ নিয়ে চিন্তা করছে, ইউটিউব মার্কেটিং নিয়ে ভাবছে। তার হাসাহাসি দেখেও অবাক হয়ে যাচ্ছি। সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে তার টাইম নেই, লাইভে আসতে তার অফুরন্ত টাইম আছে…।’
চুমকির শেষ ইচ্ছা
————-
দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় গ্রেপ্তার এড়িয়ে প্রদীপ দাসের স্ত্রী চুমকি রাণী দাস গা ঢাকা দিয়ে চট্টগ্রামেই অবস্থান করছেন। স্বামীকে রক্ষার অনেক দায়িত্ব তারই কাধে। সর্বশেষ তিন দিনের রিম্যান্ড মঞ্জুর করাকালেই আদালত পুণরায় রিম্যান্ড প্রার্থনা মঞ্জুর না করার বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছে। এতেই আশার প্রদীপ দেখতে পাচ্ছেন চুমকি রাণী। তিনি নানাভাবে জেলখানায় আগাম সব ব্যবস্থা প্রস্তুত করার কাজেই বেশি ব্যস্ত থাকছেন। আদালত থেকে জেলহাজতে পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গেই প্রদীপকে যাতে জেল হাসপাতালে ভর্তি করা যায় এবং দ্রুতই তার শারিরিক অবস্থার অবনতি দেখিয়ে ঢাকার কোনো স্পেশালাইজড হাসপাতালে স্থানান্তর করার আগাম ব্যবস্থা নিচ্ছেন তিনি। জেল হাসপাতাল থেকে বাইরের হাসপাতালে নেয়া গেলেই দ্রুত তাকে জীবন রক্ষার্থে ভারতের উন্নত হাসপাতালে রেফার্ড করাতে পারাই হচ্ছে চুমকি রাণীর শেষ ইচ্ছা।