সাঈদুর রহমান রিমন'র অনুসন্ধানী রিপোর্ট

মেজর সিনহা হত্যা: কত কিছুই যে অজানা

প্রকাশিত: ৭:৪১ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ২৬, ২০২০

Warning: Undefined array key "mode" in /home/vorercoxb/public_html/wp-content/plugins/sitespeaker-widget/sitespeaker.php on line 13
print news

টেকনাফ মডেল থানার গায়েব হওয়া সিসিটিভি’র ফুটেজ যে ওসি প্রদীপের সহযোগিদের কাছেই লুকিয়ে রাখা আছে তার প্রমান মিলেছে। গত ২৩ আগস্ট বিভিন্ন ইউটিউব ও একাধিক চ্যানেলে সিফাতের বক্তব্য হিসেবে যে ভিডিওটি চালানো হয়েছে সেই ভিডিওটুকু টেকনাফ থানার সিসিটিভি ফুটেজেরই এডিট করা অংশ। প্রদীপ চক্রের সহযোগী যেসব পুলিশ সদস্য সিফাতের প্রায় ১১ মিনিটের দীর্ঘ ভিডিও বক্তব্য বাজারে ছেড়েছে তাদের হাতেই রয়েছে থানার গায়েব হওয়া ভিডিও ফুটেজ, সিসিটিভির হার্ডড্রাইভ।

ঘটনার রাতে মেজর সিনহা হত্যাকান্ডের পরক্ষণেই সিফাতকে পিছমোড়া করে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে আসামি হিসেবে টেকনাফ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ভীতসন্ত্রস্ত, বিধ্বস্ত সিফাতকে ইন্সপেক্টর (তদন্ত) এর কক্ষে নিয়েই তিন পুলিশ কর্মকর্তা একের পর এক প্রশ্ন ছুঁড়তে থাকেন। সিফাত তখন মেজর সিনহা হত্যাকান্ডসহ তিন মামলার আসামি হিসেবে অনিশ্চিত ভয়াবহতার মুখোমুখি, ভবিষ্যত তার গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত। কোনো কোনো চ্যানেল ও ইউটিউবে তার হ্যান্ডকাপ লাগানো অংশটুকু হাইড করে ভিডিও বক্তব্য প্রচার করেছে। প্রদীপের ভক্ত সহযোগিদের হাতে গ্রেফতার থাকাবস্থায় সিফাতকে দিয়ে যা কিছু বলানো হয়েছে তার প্রতি হঠাৎ এতোটা বিশ্বাস জন্মানোর কারণ কী-এমন প্রশ্ন তুললেও কারো ক্ষোভের কারণ দেখি না।
উল্লেখ্য, অভিযোগ উঠেছে গত ১২ আগস্ট গভীর রাতে এএসআই সুজিত ও কং সাগরের মাধ্যমে থানা সিসিটিভির হার্ডডিস্কটি খুলিয়ে চুমকির লাগেজে ভরা হয় বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রটি নিশ্চিত করেছে। পাশাপাশি পরদিন ১৩ আগস্ট বৃহস্পতিবার চুমকি তার সবকিছু গুছিয়ে টেকনাফ থানার বাংলো ছেড়ে তার চট্টগ্রামের বাসায় চলে যান। এখন সেই হার্ডড্রাইভ খুঁজে সিফাতের আদায় করা বক্তব্যের একাংশ এডিট করে বাজারে ছাড়া হয়েছে। প্রদীপ চক্রের সহযোগিরা সবাই শুধু ‘মেজর সিনহার হত্যাকান্ড পরিকল্পিত’ সংক্রান্ত যাবতীয় প্রমানাদি ধামাচাপা দেয়ার কাজেই বেশি ব্যস্ত। তারই অংশ হিসেবে থানার সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব করা হয়েছে।


এসপি মাসুদেই প্রশ্নবিদ্ধ সরকারের সদিচ্ছা


শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) সিনহা রাশেদের নির্মম হত্যাকান্ডের পর যতই দিন গড়াচ্ছে দায়িত্বশীলদের ব্যর্থতার পাল্লা ততই যেন ভারি হচ্ছে। তদন্ত ক্ষেত্রেও নানা ফাঁক ফোকর চোখে পড়ছে। সকল ক্ষেত্রেই চলছে অভিযুক্ত এসপি এবিএম মাসুদের নগ্ন হস্তক্ষেপ। তারই তত্বাবধানে সুপরিকল্পিত ভাবে একের পর এক আলামত বিনষ্ট করা হচ্ছে। মূলত: এক এসপি’র কারণেই মেজর সিনহা হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচণ ও কঠোর বিচারের ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছা বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে। গোটা সরকারকে বিতর্কিত করে এসপিকে বহাল রাখার মাধ্যমে কার স্বার্থ হাসিল হচ্ছে- তা নিয়ে সকল মহলেই চলছে নানা গুঞ্জন।

এদিকে মেজর (অবঃ) সিনহা মোঃ রাশেদ খান হত্যার গুরুত্বপূর্ণ আলামত টেকনাফ মডেল থানার সিসিটিভির ফুটেজ সরিয়ে ফেলা এবং র্যাব কর্তৃক গ্রেপ্তারকৃত আসামি নুরুল আমিনের মাকে বাদী সাজিয়ে ‘ছেলে অপহরণের’ অহেতুক মামলা রুজু করার কারণে তাৎক্ষণিকভাবে ওসি মোঃ আবুল ফয়সল’কে সরিয়ে দেওয়া হয়। ওসি হিসেবে যোগদানের মাত্র ১১ দিনের মাথায় গত ২০ আগস্ট পুলিশ সদর দপ্তরের এক আদেশে মোঃ আবুল ফয়সালের চাকুরী আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ান (APBn-এপিবিএন) এ সংযুক্ত করা হয়েছে। একই সাথে টেকনাফ মডেল থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) এবিএমএস দোহাকে নতুন ওসি নিয়োগ না দেওয়া পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত ওসি’র দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু অদ্যাবধী আবুল ফয়সালই টেকনাফ থানায় ওসির চেয়ার দখল করে আছেন। বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমারের অসমাপ্ত কর্মকান্ড সম্পাদনেই তিনি বেশি ব্যস্ত থাকছেন। পাশাপাশি নানা ফন্দিফিকিরে সিনহা হত্যা মামলার তদন্তে দীর্ঘসূত্রিতার জটিলতা বাধাচ্ছেন।

 

হত্যার মোটিভ নির্ধারণের আলামত মেলেনি

মেজর সিনহা হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা র‍্যাব-১৫ এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম গত ১৮ আগস্ট আদালতের অনুমতি নিয়ে টেকনাফ মডেল থানার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করতে যান। কিন্তু আইও তাঁর তদন্ত কাজের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় মনে করা সেই সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করতে পারেননি। টেকনাফ মডেল থানার বিদায়ী ওসি মোঃ আবুল ফয়সল আইও মোহাম্মদ খায়রুল ইসলামকে জানালেন-সিসিটিভি’র রেকডিং নষ্ট থাকায় সিসিটিভি’র ফুটেজ দেওয়া যাচ্ছেনা। ‘সিসিটিভি’র রেকডিং নষ্ট থাকায় সিসিটিভি’র ফুটেজ দেওয়া সম্ভব হয়নি’ মর্মে লিখিত নিয়ে মামলার আইও র‍্যাব-১৫ এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম টেকনাফ মডেল থানা থেকে নিরাশ হয়ে ফেরত আসেন। সবাই অবাক হন, টেকনাফ থানা একটি মডেল থানা হওয়া সত্বেও কেন সিসিটিভি’র রেকডিং নষ্ট ছিলো! সবার ধারণা, সিসিটিভি ফুটেজে সিনহা হত্যা সংক্রান্ত স্পর্শকাতর বিষয় থাকায় তা মূলত সরিয়ে ফেলা হয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিসিটিভি’র ফুটেজ না পাওয়ার বিষয়টি এরইমধ্যে তাঁর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও আদালতকে অবহিত করেছেন।

অপরের অস্ত্রে লিয়াকতের গুলি

সিনহার ওপর যে অস্ত্র দিয়ে গুলী করা হয়েছে সেটা কার? তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন এই মামলার অন্যতম আসামী এবং পুলিশের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নন্দ দুলাল দাবি করেছেন ইনস্পেক্টর লিয়াকত তার অস্ত্রটি নিয়ে সিনহার ওপর ৪টি গুলী করেছেন। অজ্ঞাত কারণে লিয়াকত তার নিজের অস্ত্র দিয়ে গুলী করেননি। তবে নিয়ম অনুযায়ী যার জন্য অস্ত্র বরাদ্দ তিনিই সেটা ব্যবহার করতে পারেন। ৩১ জুলাই মেজর সিনহা হত্যাকান্ডে এই ব্যত্যয়টি কেন ঘটেছে সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিনিয়র এএসপি খাইরুল ইসলাম পুলিশ লাইন্সে গিয়ে হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত অস্ত্রটি সংগ্রহ করেছেন। অস্ত্রটির ব্যালেস্টিক রিপোর্টের জন্য সিআইডিতে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

গাজা দেয় বাবুল, বাবা জহিরুল

৩১ আগস্ট রাতে ইন্সপেক্টর লিয়াকতের গুলিতে মেজর সিনহা যখন রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে কাতরাচ্ছিলেন ঠিক সেই মুহূর্তেই শামলাপুর পুলিশ ফাঁড়ির ক্যাশিয়ার খ্যাত আব্দুল্লাহ আল মামুন ছোটাছুটিতে ভীষণ ব্যস্ত ছিলেন। তিনি একবার ফাঁড়িতে ঢুকেন আরেকবার ছুটে যান পাশের শামলাপুর বাজারে। কিছু সময়ের মধ্যেই
শামলাপুর বাজারের সেলুন দোকানি বাবুল দৌড়ে এসে টিস্যু পেপারে মুড়িয়ে কিছু পরিমাণ গাজা পৌঁছে দিয়ে যায় আব্দুল্লাহ আল মামুনের হাতে। ছুটে আসে স্থানীয় ইয়াবা বিক্রেতা জহিরুল। সেও মামুনের হাতে ৫০টি ইয়াবার একটি প্লাস্টিক প্যাকেট পৌঁছে দেয়। ক্যাশিয়ার মামুন এসব মাদক ইন্স‌পেক্টর লিয়াকতের হাতে পৌঁছে দিলে লিয়াকত তা মেজর সিনহার গাড়ির ভিতরে রেখে দেয়। পরবর্তীতে বিষয়টি ওসি প্রদীপকে জানিয়ে ‘মেজর সিনহার কাছ থেকে ইয়াবা ও গাজা পাওয়া গেল’ মর্মে জব্দ তালিকায় লিপিবদ্ধ করে।

মেজর সিনহাকে নির্মমভাবে হত্যা করার পরও তার ললাটে মাদকাসক্ত’র কালিমা লেপনের অপচেষ্টায় অংশ নেয়া বাবুল ও জহিরুলের অপরাধ এখনো আমলে নেননি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তাদেরকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদের বাইরেই রাখা হয়েছে, এমনকি সাক্ষী হিসেবেও তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। একইভাবে ঘটনার পরেই একটি মাইক্রোবাস ও একটি পিকআপযোগে প্রদীপের সহযোগী হিসেবে যারা উর্দ্ধশ্বাসে ঘটনাস্থলে হাজির হন তাদের কারো খোঁজ পাননি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। থানার নির্ভরযোগ্য সূত্রটি জানায়, ওই রাতে ওসি প্রদীপের সঙ্গী হিসেবে এসআই সজীব, এসআই মিথুন ভৌমিক ও জনৈক কনস্টেবল ছিলেন। তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাওয়ার খবর পেয়েই এসপি এবিএম মাসুদ ওই তিন পুলিশ সদস্যকে তাৎক্ষণিকভাবে টেকনাফ থানা থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত করেন বলেও জানা গেছে।