জনপ্রতিনিধিরাই ভাগাভাগি করে বিতরণ করেন কমিটির পদ
৭৩ বছর বয়সী ছাত্রলীগের নেতা ঠিক হয় প্রভাবশালীদের কোটায়, ঝরে পড়ে মেধাবীরা
Warning: Undefined array key "mode" in /home/vorercoxb/public_html/wp-content/plugins/sitespeaker-widget/sitespeaker.php on line 13
গৌরবের ছাত্রলীগ এখন ভুগছে ইমেজ সংকটে— একথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নিচ্ছেন সংগঠনের সাবেক শীর্ষনেতারাও। সংগঠনটির যে কোনো পর্যায়ের নেতৃত্ব নির্বাচনকে ঘিরে বিতর্ক তৈরি হওয়া যেন এখন অনিবার্য ঘটনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সাংসদ, উপজেলা চেয়ারম্যানসহ জনপ্রতিনিধিরাই ভাগাভাগি করে ছাত্রলীগের কমিটির পদ বিতরণ করছেন। এর ফলে জনপ্রতিনিধিদের পছন্দ বা অনুগত না হলে অনেক যোগ্য তরুণকেও ঝরে পড়তে হয় অকালে।
গুণে গুণে ৭৩ বছর পার করলো বাংলাদেশের প্রাচীনতম ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি ও দেশের স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা এই সংগঠনটিকে ঘিরে গত এক দশক ধরে চলে আসছে নানান সমালোচনা। গৌরবময় পথ পাড়ি দিয়ে আসা ছাত্রলীগ এখন ইমেজ সংকটে ভুগছে বলে মনে করছেন ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা। শত বিতর্কের মধ্যে সবচেয়ে বহুল বিতর্কিত ইস্যু হচ্ছে সংগঠনটির নেতৃত্ব নির্বাচন।
সংগঠনটির যে কোনো পর্যায়ের নেতৃত্ব নির্বাচনকে ঘিরেই বিতর্ক তৈরি হওয়া এখন যেন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে ছাত্রলীগের কমিটির পদ ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে। অর্থাৎ কোনো উপজেলায় কমিটি করতে গেলে সেই উপজেলার সাংসদ, উপজেলা চেয়ারম্যান কিংবা আওয়ামী লীগের সভাপতিকে কোটা ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে ছাত্রলীগের পদ। এক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের পছন্দ না হলে অনেক যোগ্য তরুণকেও হারাতে হচ্ছে সংগঠন করার অধিকার।
একসময় দেশ কোন্ পথে আগাবে— সেই পথ ঠিক করে দেওয়া ছাত্রলীগ আজকের দিনে নিজেদের নেতা নির্বাচন করার অধিকারটুকুও পাচ্ছে না। সংগঠনটির সোনালী অতীতে নেতৃত্ব দেওয়া সাবেক ছাত্রনেতারা বলছেন, এখন নেতৃত্ব বের হচ্ছে জনপ্রতিনিধিদের পকেট থেকে। তারা বলছেন, এখনকার ছাত্রলীগ মুক্ত সংগঠন নয়। এসবের জন্য সংগঠনটির বর্তমান নেতাকর্মীদের আদর্শিক চেতনার অভাব, স্বকীয়তা না থাকা আর মেধাবৃত্তিক চর্চার অনাগ্রহকে দুষছেন তারা।
তবে দেশের স্বার্থেই ছাত্রলীগের ইমেজ পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে সচেতন হতে বর্তমান নেতৃবৃন্দের প্রতি অনুরোধ তাদের।
জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব ভাগাভাগি করে দেওয়ার বর্তমান প্রবণতাকে দুঃখজনক উল্লেখ করে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক শেখ আতাউর রহমান আতা বলেন, ‘এই প্রবণতাটা মোটেও সমর্থন করি না। দলের একজন দায়িত্বশীল হিসেবে আমিও চাই ছাত্রলীগ স্বকীয়ভাবে তাদের সাংগঠনিক কাঠামো ধরে রাখুক।’
তবে এজন্য বর্তমানের স্বার্থপর রাজনৈতিক চর্চাকে দায়ী করে আতা বলেন, ‘শুধু ছাত্রলীগকে এক্ষেত্রে একা দায়ী করার পক্ষে আমি নই। আমরা আজকাল যারা রাজনীতি করছি তাদের বেশিরভাগই স্বার্থপর হয়ে রাজনীতি করছি। জাতীয়ভাবে সামাজিকভাবে কিংবা স্থানীয়ভাবে কোথাও নিঃস্বার্থ রাজনৈতিক বোধের চর্চাটা নেই। সকলেই নিজের স্বার্থের যোগ বিয়োগ করে রাজনীতি করছে। এখানেই সকল সমস্যা।’
জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে ছাত্রলীগের পদ ভাগ করে দেওয়াকে রাজনীতির বিরাট অবক্ষয় হিসেবে চিহ্নিত করে একসময় চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের দায়িত্ব পালন করে বর্তমানে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বরত মফিজুর রহমান বলেন, ‘ছাত্রলীগের নেতৃত্ব জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার রেওয়াজ অতীতে কখনোই ছিল না। এখন এটা কেন করে, কী জন্য করে আমি বুঝতে পারি না। এটা উচিত নয়। ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নিয়মিত ছাত্রদের হাতেই ফিরিয়ে দিতে হবে। এটা করতে না পারার কারণে ছাত্রলীগের অতীতের গৌরব অনেকটাই ম্লান হয়ে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যখন ছাত্রলীগ করতাম তখন কোয়ালিটি দেখে মেধাবীদের নেতৃত্বে আনা হতো। সেখানে আমরা দেখতাম যোগ্যতা। কোন্ নেতা কী বললো, কে কার পকেট থেকে বের হলো— আমরা সেটা চিন্তাও করিনি।’
ছাত্রলীগের অতীত ও বর্তমানের রাজনীতির পার্থক্য তুলে ধরে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ সভাপতি ও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা যখন রাজনীতি করেছি তখনকার প্রেক্ষাপট ও প্রেক্ষিতের সাথে এখনকার প্রেক্ষাপট ও প্রেক্ষিতের অনেক তফাৎ। আমরা একটা গরিব দেশে আদর্শিক একটা চেতনাকে সামনে রেখে কাজ করেছি। এখন আমাদের দেশটা উন্নয়নশীল দেশ। তবে এখনকার প্রেক্ষিতে ছাত্রনেতাদের আদর্শিক বোধের জায়গাটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শক্তপোক্ত নয়।’
বর্তমানে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে গঠনতান্ত্রিক চর্চার অভাব রয়েছে মন্তব্য করে আজম নাছির উদ্দিন বলেন, ‘এখন কমিটি একটা একসময় হলে তারা শিক্ষাজীবন শেষ করে চাকরিজীবনে গিয়ে বিয়ে করে ফেলার পরেও দেখা যাচ্ছে কমিটির মেয়াদ শেষ হয় না। অনেকে দেখা যাচ্ছে বাচ্চা-কাচ্চার পিতা হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পদটা থেকে যাচ্ছে। অথচ আগে ছাত্রত্ব শেষ হলে কেউই পদে থাকতে পারতো না, থাকতে চাইতোও না।’
তিনি বলেন, ‘এখন যেহেতু ছাত্ররাজনীতি আদর্শনির্ভর না, সেহেতু কোনো কর্মীসভা নাই। অথচ আমরা তো সে সময় নিয়মিত কর্মীসভা করতাম। ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং করতাম। এখন ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং আছে? কেউ বলতে পারবে? এখন তো বিশাল বিশাল কমিটি হয়। অনেকে জানেও না কত সদস্যের কমিটিতে সে আছে। অনেক ক্ষেত্রে একই কমিটির একজন আরেকজনকে চেনে না। একটা কমিটির সবাই মিলে একত্রে বসাও হয় না একবারের জন্যও। কাজেই পরস্পরের সাথে পরস্পরের যে বোঝাপড়া, আন্তরিকতা, আস্থা বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে উঠার কথা সেটা একদমই হয়ে ওঠে না।’
এসব থেকে মুক্তি পেতে ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে গঠনতন্ত্রকেই আঁকড়ে ধরার পরামর্শ দিয়ে একসময় চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে নেতৃত্ব ভাগাভাগি হতে যাবে কেন? ছাত্রলীগ একটা সংগঠন, এর গঠনতন্ত্র আছে। একটা কমিটি কেমন হবে, কত দিন তার মেয়াদ হবে, কারা কমিটিতে থাকতে পারবে কারা পারবে না— এগুলো তো গঠনতন্ত্রেই উল্লেখ আছে। গঠনতন্ত্র মেনে চললে তো এই প্রশ্নগুলো আসার কথা না। এখন যেভাবে চলছে এভাবে চলতে থাকলে দলে সুবিধাবাদী হাইব্রিডদের আধিপত্য বাড়তে থাকবে। আর রাজনীততে আদর্শ বলে কোন কথা থাকবে না।’
ছাত্রলীগের কাছে নিজেদের প্রত্যাশার কথা তুলে ধরে সাবেক নেতাদের সকলেই এক সুরে পরামর্শ দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে গঠনতন্ত্র মেনেই রাজনীতি করার। পাশাপাশি অছাত্রদের বাদ দিয়ে নিয়মিত ছাত্রদের রাজনীতির নেতৃত্বে আনার প্রতি বিশেষভাবে যত্নবান হতে বর্তমান ছাত্রলীগ নেতাদের পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।