করোনায় আটকে গেছে আলোচিত সব মামলার বিচার

প্রকাশিত: ১২:৩৭ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২৫, ২০২১
print news

মহামারি করোনায় থমকে গেছে জনজীবন। প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে এক বছরের বেশি সময় ধরে ভার্চুয়ালি চলছে আপিল বিভাগ। বন্ধ রয়েছে আপিল বিভাগের নিয়মিত আদালত। হাইকোর্ট বিভাগেও ভার্চুয়ালি স্বল্প পরিসরে বিচার কার্যক্রম চলছে। এ অবস্থায় আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকা আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর মামলাগুলোর শুনানি আটকে গেছে। ভার্চুয়ালি নয় করোনার প্রকোপ শেষে শারীরিক উপস্থিতিতে নিয়মিত আদালতে এ সব মামলার শুনানি হবে।

আলোচিত মামলার মধ্যে ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউ শুনানি, যুদ্ধাপরাধ মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলাম, সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ কায়সারের রিভিউ শুনানি ও সাতখুন মামলা আপিল বিভাগে রয়েছে। এছাড়া রমনা বটমূলের বোমা হামলা মামলা, নুসরাত হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলা হাইকোর্টে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।

রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেছেন, নিয়মিত আদালত খুললে গুরুত্বপূর্ণ মামলা শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হবে।

ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউ শুনানি : ২০১৭ সালের ৩ জুলাই ওই সময়ের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন ৭ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেন।

২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর বিচাপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে এনে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন দাখিল করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় রাষ্ট্রপক্ষ ৯০৮ পৃষ্ঠার এ রিভিউ আবেদন দাখিল করেন। দীর্ঘ দিন ধরে আপিল বিভাগে ঝুলে রয়েছে ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউ ‍শুনানি।

এ মামলার বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, নিয়মিত আদালত খুললেই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হবে। আমরা দ্রুত শুনানির জন্য নিয়মিত আদালতে আবেদন করব।

দুই যুদ্ধাপরাধীর রিভিউ শুনানি : মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত দুই আসামি এটিএম আজহারুল ইসলাম ও জাতীয় পার্টির নেতা সৈয়দ মুহম্মদ কায়সারের রিভিউ আবেদন আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। শারীরিক উপস্থিতিতে নিয়মিত আদালতে মামলার রিভিউ শুনানি হবে বলে জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।

২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ এটিএম আজহারের ফাঁসি বহাল রেখে রায় ঘোষণা করেন। গত বছরের ১৫ মার্চ এ মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। পরে একই বছরের মে মাসে আপিল বিভাগে রিভিউ আবেদন করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১, জামায়াতে ইসলামের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড দেন। পাশাপাশি তাকে ৩০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

অন্যদিকে গত বছরের ২৯ অক্টোবর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার খালাস চেয়ে রিভিউ আবেদন দাখিল করেন। রিভিউ আবেদনে ১৮টি যুক্তি দেখিয়ে মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস চাওয়া হয়েছে।

এর আগে গত বছরের ২১ অক্টোবর সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় প্রকাশ করেন আপিল বিভাগ।

গত বছরের ১৪ জানুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রাক্তন প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।

সাত খুন মামলা : দেশ কাঁপিয়ে দেওয়া আলোচিত সাত খুন মামলার আসামিদের চূড়ান্ত আপিল শুনানি এখনও শুরু হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষ এবং আসামি পক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, করোনা শেষে নিয়মিত আপিল বিভাগের কার্যক্রম শুরু হলেই তারা এ চাঞ্চল্যকর মামলার আপিল শুনানির উদ্যোগ নেবেন।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘করোনার কারণে এখনও ভার্চুয়ালি আপিল বিভাগ চলছে। যখন নিয়মিত আপিল বিভাগে কার্যক্রম শুরু হবে, তখন আমরা ডেফিনেটলি কোর্টের সামনে সাত খুন মামলাসহ সব চাঞ্চল্যকর মামলার আপিল শুনানির জন্য মেনশন (উপস্থাপন) করব। দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য পদক্ষেপ নেব।’

আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এফ আর এম লুৎফর রহমান আকন্দ বলেন, এটা তো অনেক বড় মামলা। এতো বড় মামলা তো ভার্চুয়ালি শুনানি করা সম্ভব না। অ্যাকচুয়াল কোর্ট শুরু হলেই আমরা আপিল শুনানির জন্য আদালতের কাছে প্রার্থনা করব।

২০১৮ সালের ১৯ নভেম্বর আলোচিত সাত খুন মামলায় হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়। রায়ে সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন, র‍্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সাবেক কোম্পানি কমান্ডার মেজর (অব.) আরিফ হোসেনসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখেন হাইকোর্ট। বাকি ১১ জনের মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। হাইকোর্টের রায় প্রকাশের পর আসামিরা মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন দণ্ড থেকে খালাস চেয়ে আপিল করেন। সেই আপিল এখন শুনানির অপেক্ষায় আছে।

রমনায় বোমা হামলা মামলা : বহুল আলোচিত রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা মামলার আপিল শুনানি হাইকোর্টে ঝুলে রয়েছে। গত ১৩ মার্চ মামলাটি শুনানির জন্য বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ ও বিচারপতি এ এস এম আব্দুল মোবিনের হাইকোর্টের তালিকায় এসেছিল। কিন্তু করোনার কারণে আবারও নিয়মিত আদালত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শুনানি আর হয়নি।

সংশ্লিষ্ট আদালতের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শাহীন আহমেদ খান বলেন, এ মামলার শুনানির জন্য আমরা প্রস্তুত রয়েছি। আদালত শুনানির শুরুর নির্দেশ দিলে আমরা শুনানি করব।

এ মামলাটির ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসার পর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক তৈরি হয়। শুনানিও শুরু হয় কিন্তু কয়েকদফা আদালত পরিবর্তন হওয়ায় গত ৭ বছরেও শেষ হয়নি মামলাটি।

২০১৪ সালের ২৩ জুন বহুল আলোচিত রমনা বটমূলে বোমা হামলা মামলার রায় ঘোষণা করেন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক রুহুল আমিন। রায়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত হরকাতুল জিহাদের (হুজি) শীর্ষ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান, বিএনপি নেতা ও সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিনসহ ৮ জনের ফাঁসি ও ৬ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন আদালত। রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়। অনাদায়ে আরও এক বছর করে কারাদণ্ডাদেশ দেন আদালত। এ রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন আসামিরা।

নুসরাত হত্যা মামলা : করোনাভাইরাসের কারণে বহুল আলোচিত ফেনীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাত হত্যা মামলায় ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের করা আপিল শুনানি আটকে রয়েছে। চাঞ্চল্যকর এ মামলার আপিল শুনানির জন্য বিচারপতি সৌমেন্দ্র সরকার ও বিচারপতি শাহেদ নুর উদ্দিনের হাইকোর্ট বেঞ্চ আগেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। গত বছরের মার্চ মাস থেকে নুসরাত হত্যা মামলা হাইকোর্টের কার্য তালিকায় রয়েছে। কিন্তু মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে এ মামলার শুনানি আটকে আছে।
নুসরাত হত্যা মামলায় ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর রায় দেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। রায়ে ফেনীর সোনাগাজীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাতকে হত্যার দায়ে বরখাস্ত হওয়া অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাসহ ১৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর ২৯ অক্টোবর ডেথ রেফারেন্সের জন্য নুসরাত হত্যা মামলার রায়সহ নথিপত্র হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় আসে। নুসরাত হত্যা মামলায় দণ্ডিত সব আসামি আপিল করেছেন।