চট্টগ্রাম মেডিকেলেই এক্সরে বিভাগের বেহাল দশা

চট্টগ্রামে এক্সরের অদৃশ্য রেডিয়েশন বিপদে ফেলছে রোগীদের, নিয়ম মানে না হাসপাতালগুলো

প্রকাশিত: ৪:৫৮ অপরাহ্ণ, মে ২৭, ২০২১
print news

যে এক্সরে মেশিন শরীরের রোগ নির্ণয় করার কথা, সেই এক্সরে মেশিনই চট্টগ্রাম নগরীর প্রায় সব হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রীতিমতো রোগাক্রান্ত। এক্সরের তেজস্ক্রিয় রশ্মির অপ্রয়ােজনীয় ও অসতর্ক ব্যবহারে রােগীর ক্ষতি হয় অনেকটা নিরবেই। অনেক সময় এ থেকে বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ারও আশঙ্কা থাকে। এক্সরে মেশিনের ব্যবহারের সামান্য ভুলেও ক্ষতির পরিমাণ অসামান্য— এটা জেনেও হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো কর্মী ও রোগীর নিরাপত্তা নিয়ে নির্বিকারই বলা চলে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, অদৃশ্য রেডিয়েশন এক্স-রে বা সিটিস্ক্যান কক্ষের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ও কারও শরীরে প্রবেশ করলে ভবিষ্যতে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আবার কোনও কারণে যদি কেউ নিয়মিত বা ঘন ঘন এক্সরে করেন, তার শরীরে রেডিয়েশন প্রবেশ করে চোখে ছানিপড়া, ক্যান্সার, গর্ভপাত, বন্ধ্যাত্ব, মাথার চুল পড়ে যাওয়াসহ নানা জটিল রোগের সৃষ্টি হয়। এমনকি গর্ভাবস্থায় এটি হলে গর্ভস্থ শিশু বিকলাঙ্গ কিংবা প্রতিবন্ধী হওয়ার সম্ভাবনা নিয়েও জন্মগ্রহণ করার ঝুঁকিতে থাকে।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের পারমাণবিক নিরাপত্তা ও বিকিরণ নিয়ন্ত্রণ (পানিবিনি) বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী চট্টগ্রামে অধিকাংশ ল্যাবে এক্সরে স্থাপনা নেই। নেই এক্সরে স্থাপনায় রেডিয়েশন হ্রাসের ব্যবস্থা। এমনকি সরকারি হাসপাতাল, বিশেষ করে বৃহত্তর চট্টগ্রামের একমাত্র রেফারেল হাসপাতাল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও এক্সরে ব্যবস্থাপনায় চলছে বেহাল দশা। জানা গেছে, ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি রোগীর এক্সরে হওয়ায় সেখানকার এক্সরে মেশিন থেকে তেজস্ক্রিয় রশ্মির রেডিয়েশন হয় বেশি। বুকের এক্সরেতে সেখানকার পুরনো মেশিনে রেডিয়েশন বেরিয়ে আসছে প্রয়োজনের চেয়ে তিনগুণ। অন্যদিকে রেডিয়েশন নির্গমনে কক্ষের দেয়াল ১০ ইঞ্চি ও দরজায় লোহা বা তামার পাতের ব্যবস্থা রাখার নির্দেশনা থাকলেও সেটি মানা হয় না।

এক্সরে স্থাপনায় ক্ষতিকর রেডিয়েশন কমানোর ব্যাপারে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। ক্ষতিকর রেডিয়েশনের ঝুঁকি থেকে বিকিরণ কর্মী ছাড়াও জনসাধারণ ও পরিবেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত কল্পে, পারমাণবিক নিরাপত্তা ও বিকিরণ নিয়ন্ত্রণ (পানিবিনি) আইন ১৯৯৩ এবং বিধিমালা ১৯৯৭ জারি করা হয়েছে। পানিবিনি বিধিমালা ১৯৯৭ এর বিধি ১৫ অনুযায়ী লাইসেন্স ছাড়া এক্সরে স্থাপনা (যেমন— এক্সরে মেশিন, সিটি স্ক্যান, মেমোগ্রাফি, ফ্লোরোকপি, এনজিওগ্রাফি, ডেন্টাল চিকিৎসা ইত্যাদি পরিচালনা করা দণ্ডনীয় অপরাধ।

সরকারি বিধিমালা অনুযায়ী, এক্সরে সম্পাত প্রদানকালে টিএলডি (রেডিয়েশন শনাক্ত করার বিশেষ ডিভাইস) ব্যাজ ধারণ করা অত্যাবশ্যক। রেডিয়েশন ঝুঁকি কমানোর লক্ষ্যে এক্সরে মেশিন চালানোর সময় কন্ট্রোল বুথ ব্যবহার, লেড, অ্যাপ্রোন, রেড, গ্লাভস এবং লেড পরিধান বাধ্যতামূলক। এক্সরে মেশিন চলাকালে সময়, দূরত্ব ও বর্মনীতি মেনে চলাও বাধ্যতামূলক। একই সাথে কমিশন থেকে পাওয়া লাইসেন্সের কপি এক্সরে কক্ষের প্রবেশমুখে লাগানোর ব্যবস্থাও বাধ্যতামূলক। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এক্সরে অপারেটর ছাড়া এক্সরে মেশিন পরিচালনা করারও নির্দেশনা আছে পানিবিনি আইনে।

কিন্তু আইন মানা তো দূরে থাক, চট্টগ্রামের ডিজিটাল এক্সরে ল্যাবগুলোর বেশিরভাগেরই লাইসেন্স নেই। মেশিনগুলো কেনা হয়েছে ১০ থেকে ১৫ বছর কিংবা তারও আগে। বিভিন্ন ল্যাব ঘুরে দেখা গেছে, পারমাণবিক শক্তি কমিশনের কোনো নির্দেশনাও সেখানে মানা হচ্ছে না।

চট্টগ্রাম নগরীর শেভরণ ও সিএসসিআরসহ হাতেগোনা কয়েকটি ল্যাবে এক্সরে বিভাগের কর্মীরা রেডিয়েশন থেকে আংশিক ঝুঁকিমুক্ত থাকলেও সেখানে ক্ষতিকর রেডিয়েশন থেকে মুক্ত থাকার নির্দেশনা পুরোপুরি মানা হয় না। দেখা গেছে, এসব ল্যাবে এক্সরে রুমের দরজা খোলা সবসময় খোলা থাকে। অন্যদিকে বিকিরণ কর্মীদের গায়ে থাকে না নির্দেশিত অ্যাপ্রোনও।

নগরীর মডেল ল্যাব, কোয়েস্ট, লাইফ কেয়ার, মিনি ল্যাব, আলট্রা আ্যাসে, চেকআপসহ প্রতিষ্ঠিত ল্যাবগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, সরকার নির্দেশিত আইন এসব ল্যাবে মানাই হয় না। এক্সরে রুমের দরজায় এমনকি নির্দেশনা পর্যন্ত লাগানো নেই।

চমেক হাসপাতালের পূর্ব গেটের কাছে লাইফ কেয়ার ল্যাবে গিয়ে দেখা গেছে, ছোট্ট একটি রুমের মধ্যে ডিজিটাল এক্সরে মেশিন বসানো। কিন্তু এ রুমে কর্মরত বিকিরণ কর্মীর গায়ে কোন টিএলডি (রেডিয়েশন শনাক্ত করার বিশেষ ডিভাইস) ব্যাজ পরা নেই। জানা গেছে, এক্সরে রুমও রেডিয়েশন নিয়ন্ত্রিত নয়।

একই অবস্থা নগরীর আগ্রাবাদে অবস্থিত শাহজালাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। সেখানে এক্সরে রুমে গিয়ে দেখা গেছে, রুমটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলেও সেই রুম রেডিয়েশন নিয়ন্ত্রিত নয়। এক্সরে রুমের সাথে লাগোয়া নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন রুম থেকে এক্সরে রিপোর্ট দেওয়া হয়।

চমেক হাসপাতাল সংলগ্ন বিভিন্ন ল্যাব ছাড়াও জামালখান, আগ্রাবাদ, বহদ্দারহাটসহ অন্যান্য স্থানে অবস্থিত এক্সরে রুমের পরিবেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের বিধিসম্মত নয়।

অন্যদিকে বৃহত্তর চট্টগ্রামের একমাত্র রেফারেল হাসপাতাল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১৫ নং রেডিওলজি ও ইমেজিং ওয়ার্ডে এক্সরে ব্যবস্থাপনায়ও পরমাণু শক্তি কমিশনের নির্দেশনা মানার ছিটেফোটা নজিরও নেই।

গত সোমবার (২৪ মে) সকালে ওই ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে চলছে বেহাল দশা। ১৫ নং রেডিওলজি বিভাগে প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ রোগী প্রতিদিন এক্সরে করে থাকেন। এছাড়া সেখানে সিটিস্ক্যান, আলট্রোসনোগ্রাফি ও এমআরআই করা হয়ে থাকে। ৫৫ থেকে শুরু করে ৪০০ টাকার মধ্যে এসব সেবা পাওয়ার কথা থাকলেও সেবা নিতে গিয়ে রোগীরা পড়ছেন রেডিয়েশন ঝুঁকির মধ্যে। অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে এক্সরে হওয়ায় রোগীরা থাকছেন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। কারণ এ ওয়ার্ডের এক্সরে রুমে রেডিয়েশন ঝুঁকি হ্রাসের কোনো ব্যবস্থাই নেই।

১৫ নং রেডিওলজি ও ইমেজিং ওয়ার্ডের সিনিয়র টেকনোলোজিস্ট আব্দুর রহিম জানান, পাঁচটির মধ্যে তিনটি মেশিনই নষ্ট। যে দুটো মেশিন চালু আছে তার মেয়াদ চলে গেছে বহু বছর আগেই। মেডিকেল টেকনোলোজিস্ট ১৫ জনের জায়গায় কর্মরত আছেন ১০ জন।

জানা গেছে, ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি রোগীর এক্সরে হওয়ায় সেখানকার এক্সরে মেশিন থেকে রেডিয়েশন বেশি হচ্ছে। মেশিন পুরাতন হওয়ায় বুকের এক্সরেতে যেখানে রেডিয়েশন দরকার ১৫ এমএস বা মিলি অ্যাম্পিয়ার ও ৬০ কিলো ভোল্টেজ, সেখানে মেশিন পুরাতন হওয়ায় রেডিয়েশন বেরিয়ে আসছে তিনগুণ। আবার অনেক সময় এক্সরে অবস্থায় মেশিন নষ্ট হয়ে গেলে রেডিয়েশন বের হয়ে আসে বেশি। নতুন এক্সরে মেশিনগুলোতে ১ হাজার মিলি অ্যাম্পিয়ার থেকে ৮০০ মিলি অ্যাম্পিয়ার পর্যন্ত থাকে। কিন্তু মেশিন নষ্ট থাকলে মেশিনের পুরো রেডিয়েশনই বের হয়ে আসে।

১৫ নং ওয়ার্ডের এক্সরে রুমে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানকার এক্সরে রুম শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নয়। এক্সরে রুমের দরজা খোলা রেখেই মেশিনে রোগীদের শুইয়ে বা দাঁড়িয়ে এক্সরে করানো হচ্ছে। রুমের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছেন ৩০ থেকে ৪০ জন রোগী। এক্সরে রুমের ভিতরে গিয়ে দেখা গেছে, কোনো বিকিরণ কর্মীর গায়ে টিএলডি ব্যাজ নেই। এক্সরে রুমের বাইরে নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন বারান্দায় দেখা গেছে এক্সরে রিপোর্ট ফ্যানের বাতাসে শুকানো হচ্ছে।

সিনিয়র টেকনোলোজিস্ট আব্দুর রহিম বলেন, ‘আমরা কখনোই টিএলডি ব্যাজ পরিনি। এক্সরে রুমের মধ্যে রোগীর সাথে যেখানে তিন ডবল রোগীর আত্মীয়স্বজন রুমে দাঁড়িয়ে থাকে, সেখানে টিএলডি ব্যাজ পরার কী দরকার?’

টিএলডি ব্যাজ পরা নিয়ে নগরীর বেসরকারি ল্যাব সিএসসিআরের রেডিওলজিস্ট দীপক কুমার ঘোষ বলেন, ‘টিএলডি ব্যাজ পরা বাধ্যতামূলক এজন্য যে একজন রেডিওগ্রাফারের গায়ে কত রেডিয়েশন লাগলো তা এই ব্যাজে সংরক্ষিত থাকে। এই ব্যাজ রেডিয়েশন শুষে নেয়।’

চমেক হাসপাতালের রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুভাষ মজুমদার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘অনেকবার ব্যবস্থা নিয়েও এক্সরে রুমকে রেডিয়েশন প্রতিরোধযোগ্য করা যায়নি। টেকনোলোজিস্টদের বলা থাকে তারা সব নিয়ম মেনে যেন রোগীকে এক্সরে করতে যায়। আর করোনার সময়ে একে তো সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত সবার। আসলে রোগীর চাপ এত বেশি থাকে নিয়ম মেনে এক্সরে করা সম্ভব হয় না। রোগ নির্ণয় করতে এসে রোগীরা নতুন করে অন্য রোগ কিংবা করোনাতেই আক্রান্ত হয়ে থাকেন।’