ঢাকার ১৯ হাসপাতালে আইসিইউ ফাঁকা নেই
করোনায় প্রাণ বাঁচাতে অনিশ্চিত ছোটাছুটি
Warning: Undefined array key "mode" in /home/vorercoxb/public_html/wp-content/plugins/sitespeaker-widget/sitespeaker.php on line 13
রাজধানীর ১৯ হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত আইসিইউ শয্যা ফাঁকা নেই। সাধারণ শয্যাও প্রায় শেষ। গত পাঁচ দিনে করোনায় গড়ে শনাক্ত হয়েছেন ৭১৪৫ জনের বেশি। এদের ৭৫ শতাংশই ঢাকার বাইরে। এর বড় অংশই উন্নত চিকিৎসা নিতে ঢাকায় আসছেন।
ফলে শয্যা সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। এদের মধ্যে মুমূর্ষু রোগীর প্রাণ বাঁচাতে স্বজনরা ছুটছেন আইসিইউর সন্ধানে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল, মুগদা মেডিকেল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হাসপাতালসহ ১৯টি থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরছেন তারা।
দেশে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় রাজধানীর সরকারি ১৬টি ও বেসরকারি ২৮টি হাপসাতাল ডেডিকেটেড করা হয়েছে। এসব হাসপাতালে কয়েক দফা সাধারণ ও আইসিইউ শয্যাও বাড়ানো হয়েছে। তারপরও সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১৯টি হাসপাতালে কোনো আইসিইউ শয্যা ফাঁকা নেই।
অবশিষ্ট হাসপাতালের মধ্যে বেশ কয়েকটিতে শয্যা ফাঁকা আছে একটি বা দুটি করে। এ পরিস্থিতিতে দেশে শুরু হয়েছে ডেঙ্গি সংক্রমণ। ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
গত দুই দিনে ২০৯ জন রোগী নতুন করে ভর্তি হয়েছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে ডেঙ্গি রোগীদের জন্য ৬টি হাসপাতাল ডেডিকেটেড করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য প্রশাসন।
সরেজমিন দেখা গেছে, কোভিড আক্রান্ত রোগী রইস উদ্দিন রোববার ঢাকায় এসেছেন উন্নত চিকিৎসার আশায়। চিকিৎসকরা বলেছেন, তার আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) প্রয়োজন।
একটি আইসিইউ শয্যার জন্য রাজধানীর এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটে বেড়িয়েছেন। কিন্তু কোথাও ফাঁকা পাওয়া যাচ্ছে না। কয়েকটি হাসপাতাল থেকে জানিয়েছে, কোনো রোগীর মৃত্যু হলে বা সুস্থ হলে শয্যা ফাঁকা হতে পারে।
একসঙ্গে দুটি সংক্রামক রোগের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতাকে উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, শয্যা সংকটে কোভিড রোগীদের চিকিৎসা ব্যাহত হওয়ার পরিস্থিতি। এমন সময়ে ডেঙ্গি রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া এক প্রকার অসম্ভব।
বিশেষ করে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গির চিকিৎসা দিতে গেলে ক্রস ইনফেকশন ঘটতে পারে। যা আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, যেভাবে রোগী বাড়ছে তাতে হাসপাতালে শয্যা সংকট দেখা দিতে পারে। ইতোমধ্যে ৮০ শতাংশ শয্যায় রোগীতে ভর্তি হয়ে আছে।
তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ড হাসপাতাল প্রস্তুত হচ্ছে। আগামী সাত দিনের মধ্যে চালু করতে পারব। আশা করছি আগামী শনিবার থেকে আমরা রোগী ভর্তি করতে পারব।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ডেঙ্গি রোগী বাড়ছে। তবে এটাকে আশঙ্কাজনক বলা যাবে না। তিনি বলেন, কোভিড রোগীদের সঙ্গে ডেঙ্গির চিকিৎসা দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ।
তাই রাজধানী ও এর আশপাশে ৬টি হাসপাতাল ডেঙ্গি ডেডিকেটেড করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এগুলো হলো-স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, রেলওয়ে হাসপাতাল, লালকুঠি হাসপাতাল, আমিনবাজার হেলথ কমপ্লেক্স, কামরাঙ্গীরচর উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স এবং টঙ্গীর শহীদ আহসানউল্লাহ মাস্টার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল। অধ্যাপক নাজমুল বলেন, খুব দ্রুত এসব হাসপাতাল ডেঙ্গির জন্য প্রস্তুত করা হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হাসপাতাল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) শয্যা খালি নেই।
এছাড়া কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা খালি আছে ১টি এবং জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ফাঁকা শয্যা মাত্র ২টি। এছাড়া বেসরকারি ২৮টি হাসপাতালের মধ্যে ১১টিতে কোনো আইসিইউ শয্যা ফাঁকা নেই। অন্যগুলোতে একটি বা দুটি করে শূন্য শয্যা আছে বলে জানানো হয়েছে।
তবে অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যুগান্তরকে জানান, মূলত আইসিইউ শয্যা যেগুলো সচল সেগুলোর একটিও ফাঁকা নেই। অধিদপ্তরের তালিকায় যেগুলোক ফাঁকা দেখানো হচ্ছে সেগুলো সচল নয় বা সেবা দিতে প্রস্তুত নয়। যেহেতু আইসিইউ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত তাই তালিকায় দেখানো হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গত ৫ দিনের তথ্যে দেখা যায়, করোনা সংক্রমণের হার ক্রমেই বাড়ছে। ২১ জুলাই শনাক্ত হয়েছিল ৭৬১৪ জন, মৃত্যু হয়েছিল ১৭৩ জনের, ওইদিন শনাক্তের হার ছিল ৩০ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
২২ জুলাই শনাক্ত হয়েছিল ৩৬৯৭ জন, মৃত্যু হয়েছিল ১৮৭ জনের এবং শনাক্তের হার ছিল ৩২ দশমিক ১৯ শতাংশ; ২৩ জুলাই শনাক্ত হয়েছিল ৬৩৬৪ জন, মৃত্যু হয়েছিল ১৬৬ জন এবং শনাক্তের হার ছিল ৩১ দশমিক ০৫ শতাংশ; ২৪ জুলাই শনাক্ত হয়েছিল ৬৭৮০ জন, মৃত্যু হয়েছিল ১৯৫ জনের, শনাক্তের হার ছিল ৩২ দশমিক ৫৫ শতাংশ; রোববার ২৫ জুলাই শনাক্ত হয়েছেন ১১২৯১ জন, মৃত্যু হয়েছে ২২৮ জনের, শনাক্তের হার ৩০ দশমিক ০৪ শতাংশ।
গত সাত দিনের সংক্রমণ পরিস্থিতিতে নমুনা সংগ্রহ কম হয়েছে এবং সে অনুযায়ী পরীক্ষাও কম হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম।
তিনি বলেন, এ কারণে মোট রোগীর সংখ্যা কমেছে। কিন্তু তাতে সংক্রমণের হার কমেনি। শতকরা হিসাবে সংক্রমণের হার ৩০ শতাংশের নিচে নামেনি। বরং ২৪ জুলাই ৩২ দশমিক ৫৫ শতাংশ রোগী শনাক্ত হয়েছে।
ডেঙ্গি পরিস্থিতি : দেশে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গি রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১০৫ জন রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। যার মধ্যে ১০২ জনই ঢাকায়। চলতি মাসের ২৫ দিনে ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ১৩০৭ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যে দেখা যায়, জানুয়ারি মাসে রোগী শনাক্ত হয় ৩২ জন, ফেব্রুয়ারি মাসে ৯ জন, মার্চ মাসে ১৩ জন, এপ্রিল মাসে ৩ জন, মে মাসে ৪৩ জন, জুন মাসে ২৭১ জন।
আক্রান্তদের মধ্যে বর্তমানে সারা দেশে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৪৬০ জন। এর মধ্যে ঢাকার ৪১টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৪৫৪ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১০৫ জন।
এই সময়ে ঢাকার বাইরে ৩ জন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এই তথ্যে ৩ জনের মৃত্যুর কথা জানানো হয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. নাজমুল হক যুগান্তরকে বলেন, এই হাসপাতালের ৭৮০ শয্যায় করোনা রোগীদের সেবা দেওয়া হচ্ছে। এটি একটি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল।
এখানকার মেডিসিন বিভাগের সব চিকিৎসক কোভিড চিকিৎসায় নিয়োজিত। বর্তমানে আমাদের পক্ষে ডেঙ্গি রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয়। তবে প্রাথমিক চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, এই মুহূর্তে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোনো আইসিইউ শয্যা ফাঁকা নেই। সাধারণ শয্যা ফাঁকা হওয়া সাপেক্ষে রোগী ভর্তি করা হয়। চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর ৭৫ শতাংশই ঢাকার বাইরের।
রোগী আরও বাড়লেও এই হাসপাতালে শয্যা বাড়ানোর জায়গা নেই। তাছাড়া কোভিড রোগীদের জন্য অক্সিজেন জরুরি। তাই অক্সিজেন লাইন নেই এমন স্থানে শয্যা বাড়ানো সম্ভব নয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনা মহামারির শুরু থেকেই দেশের বৃহৎ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে কোভিড ডেডিকেটেড ঘোষণা করা হয়। ওই সময় ৫৮০ শয্যা কোভিড রোগীদের জন্য ছেড়ে নির্ধারণ করা হয়।
পরে রোগী বাড়লে আরও ২০০ শয্যা যুক্ত করা হয়। কোভিড রোগীদের চিকিৎসার বাইরে রেফারকৃত জরুরি সার্জারির ও নবজাতকদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
সরকারি পর্যায়ে রাজধানীর আরেকটি বড় চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এই হাসপাতালটিও কোভিড রোগীদের জন্য নির্ধারিত। ৮৫০ শয্যার এই হাসপাতালের ৫০০ শয্যায় কোভিড রোগীদের সেবা দেওয়া হয়।
এই শয্যাগুলোতে কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেনের লাইন সংযোগ দেওয়া আছে। এই শয্যা বাড়ানো প্রায় অসম্ভব। ২০১৯ সালে এই হাসপাতাল ডেঙ্গি চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এ বিষয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. খলিলুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, কোভিড ও ডেঙ্গি রোগীর চিকিৎসা একসঙ্গে করা সম্ভব নয়। এতে রোগীদের ক্রস ইনফেকশন হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
তাছাড়া কোভিড রোগীদের চিকিৎসা অক্সিজেনে সংযোগ জরুরি। তাই চাইলেও শয্যা বাড়ানো সম্ভব নয়। তিনি বলেন, এই হাসপাতালে ডেঙ্গি রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয়।