মায়ের ডায়ালাইসিস ফি কমানোর আন্দোলনে গিয়ে কলেজছাত্র কারাগারে
মোহাম্মদ আবদুল হালিম মোহাম্মদ আবদুল হালিম
বার্তা সম্পাদক
Warning: Undefined array key "mode" in /home/vorercoxb/public_html/wp-content/plugins/sitespeaker-widget/sitespeaker.php on line 13
নাসরিন আক্তার (৪৩)। গত ছয় বছর ধরে কিডনি রোগে আক্রান্ত। সপ্তাহে তিন দিন করে মাসে ১২ দিন ডায়ালাইসিস করতে হয়। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অবস্থিত ডায়ালাইসিস সেন্টারে তিনি চিকিৎসা করান। ১ জানুয়ারি থেকে বাড়ানো হয়েছে ডায়ালাইসিসের ফি। এই নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে ফি কমানোর দাবিতে আন্দোলন করছেন ডায়ালাইসিস সেবা গ্রহণকারী রোগী ও তাদের স্বজনরা। আন্দোলন থেকে পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে করা মামলায় মঙ্গলবার (১০ জানুয়ারি) গ্রেফতার হন নাসরিন আক্তারের কলেজ পড়ুয়া মেধাবী ছেলে মো. মোস্তাকিম (২২)। তিনি নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন জালালাবাদ অক্সিজেন এলাকার মৃত খালেদ আজমের ছেলে।
মা নাসরিন আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার দুটি কিডনি নষ্ট। ছয় বছর ধরে ডায়ালাইসিস করে আসছি। আমার স্বামী ২০১৪ সালে মারা গেছেন। আমার এক ছেলে ও ১০ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী এক মেয়ে রয়েছে। ছেলে বড়। সে চট্টগ্রাম কলেজে অনার্সে পড়ছে। আমার সপ্তাহে তিন দিন করে প্রতি মাসে ১২ বার ডায়ালাইসিস করতে হয়। ডায়ালাইসিস বাবদ মাসে খরচ হয় ১৫ হাজার ২২০ টাকা। আমার ছেলের টিউশনি থেকে আয় এবং আমি আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে নিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছি। আমার পুরো সংসার চলছে ছেলের টিউশনির আয়ে। আমার চিকিৎসার খরচ কমানোর প্রতিবাদ করতে গিয়ে এতিম ছেলেকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। ছেলে এখন কারাগারে। আমি কীভাবে চিকিৎসা করাবো? কোথায় থেকে দুবেলা খাবার পাবো? ছেলেকেও কীভাবে কারাগার থেকে জামিন করাবো বুঝতে পারছি না।’
তিনি বলেন, ‘মাসে ১২ বার ডায়ালাইসিসের মধ্যে আট বার করা হতো ভর্তুকিতে ৫১০ টাকা করে। বাকি চারবার করা হতো ভর্তুকি ছাড়া দুই হাজার ৭৮৫ টাকায়। তবে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে হঠাৎ বাড়িয়ে দেওয়া হয় ডায়ালাইসিসের ফি। আগে যেখানে ভর্তুকিতে ৫১০ টাকা ছিল তা করা হয় ৫৩৫ টাকা। ভর্তুকি ছাড়া নতুন ফি নির্ধারণ করা হয় দুই হাজার ৯৩৫ টাকা। আগে পুরো মাসে ভর্তুকিতে আটটি ডায়ালাইসিস করানো হলেও এবার ছয়টির সিরিয়াল পাওয়া গেছে। তার মানে মাসে ১২টির মধ্যে ছয়টি ভর্তুকি ছাড়া দিতে হবে। এতে খরচ পড়বে মাসে ২০ হাজার ৮২০ টাকা। এ টাকা আমার মতো দরিদ্র মানুষের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়।’
এদিকে, ছেলেকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে জানতে পেরে মধ্যরাত পর্যন্ত পাঁচলাইশ থানার সামনে কাটিয়েছেন নাসরিন আক্তার। বার বার থানার কনস্টেবল থেকে ওসির দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। নাসরিন আক্তার বলেন, ‘আমার ছেলেকে ছাড়াতে অনেক পুলিশের হাতে-পায়ে ধরেছি। তারা আমার কথা শোনেনি। শেষ পর্যন্ত বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। কারাগারে পাঠিয়েছে।’
তার প্রতিবেশী রেজাউল করিম বলেন, ‘পুলিশ যে মোস্তাকিমকে ধরে নিয়ে গেছে, সে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। এলাকায় তার সুনাম আছে। মায়ের চিকিৎসা এবং সংসার চলছে তার টিউশনির টাকায়। এমন একজন ভালো ছেলেকে পুলিশ কোনও কারণ ছাড়াই ধরে নিয়েছে।’
পাঁচলাইশ থানার ওসি নাজিম উদ্দিন মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে দাবি করেন, ‘ডায়ালাইসিস ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে কিছু লোক হাসপাতালের সামনে মূল সড়ক বন্ধ করে বিক্ষোভ করছিল। আমরা তাদের সরে যেতে বললে পুলিশের ওপর হামলা করে। মোস্তাকিম নিজেই আমার ওপর হামলা করেছে। তাকে ঘটনাস্থল থেকে গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনায় এসআই মোস্তাফিজুর রহমান বাদী হয়ে মামলা করেছেন। মোস্তাকিমকে এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তার নাম উল্লেখ করে আরও ৫০-৬০ জনকে মামলায় অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে।’
এদিকে মোজাম্মেল হক নামে ডায়ালাইসিস ফি কমানোর আন্দোলনে অংশ নেওয়া ব্যক্তি দাবি করেন, ‘আমরা বর্ধিত ফি কমানোর দাবি জানিয়ে আসছি। এত টাকা দিয়ে ডায়ালাইসিস করানো আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে সরকার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে এ দাবি জানিয়ে আসছি। এ আন্দোলনে বুধবার পুলিশ অতর্কিতভাবে হামলা চালিয়ে ১০-১৫ জন কিডনি রোগী ও স্বজনদের আহত করেছে। কয়েকজনকে প্রকাশ্যে পিটিয়েছে। এখন মিথ্যা-বানোয়াট একটা মামলা দিয়েছে। বলছে, পুলিশের ওপর আন্দোলনকারীরা হামলা চালিয়েছে। পুলিশের ওপর আন্দোলনকারীরা হামলা চালিয়েছে এ ধরনের কোনও ছবি বা ভিডিও পুলিশ দেখাতে পারবে না। বরং পুলিশ নিরীহ লোকজনের ওপর অতর্কিতভাবে হামলা চালিয়ে মারধর করছে এ রকম ভিডিও একাধিক টিভি চ্যানেল এবং পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।’
এদিকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার কলেজছাত্রকে বিনা পয়সায় আইনি সহায়তা দিচ্ছে মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইট ফাউন্ডেশন (বিএইচআইএফ)। আগামীকাল বৃহস্পতিবার মোস্তাকিমের জামিন শুনানি হবে আদালতে।
এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার সংগঠক অ্যাডভোকেট জিয়া হাবিব আহসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের সাংবিধানিক একটি মানবাধিকার সংগঠন আছে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি- এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য। অতি উৎসাহী পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অতিউৎসাহী ভূমিকার বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। এ বিষয়ে রাষ্ট্র যথাযথ ভূমিকা রাখবে- আমরা এই আশা করি।’
সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি আকতার কবীর চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রতিবাদ করা, কথা বলা এটা স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে অধিকার। বলতে না দেওয়া, বাধা দেওয়া এটা জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা। ডায়ালাইসিসের ফি সহনশীলতার বাইরে চলে গেছে। এটার জন্য প্রতিবাদ জানিয়েছে, কথা বলেছে। এর জন্য প্রতিবাদকারীকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে- এটা কাম্য নয়। এ ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমি নিন্দা জানাই। অবিলম্বে এ মামলা প্রত্যাহার করা জরুরি।’
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ৫ মার্চ চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ৩১টি মেশিন নিয়ে ডায়ালাইসিস সেন্টার চালু করা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বেসরকারি অংশীদারিত্বের চুক্তি অনুযায়ী ‘স্যান্ডো’ নামে একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান ১০ বছরের চুক্তিতে সেখানে কার্যক্রম চালাচ্ছে।