একটি ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির জেগে উঠার অপেক্ষা

প্রকাশিত: ৪:০২ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২১

Warning: Undefined array key "mode" in /home/vorercoxb/public_html/wp-content/plugins/sitespeaker-widget/sitespeaker.php on line 13
print news

একটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরি নিঝুম হয়ে বসে আছে। সে কতক্ষণ নিঝুম থাকবে? পুরো উখিয়া টেকনাফ, রামু, নাইক্ষ্যংছড়ি এরকম একটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরির উপর নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছে বলা যায় । না তার নেতার, না তার কর্মীর, না তার জনগণ এই বিষয়ে একেবারেই উদাসীন। অথচ কি নির্বিঘ্ন হয়ে এই এলাকার দলীয় নেতারা এই সুপ্ত আগ্নেয়গিরির উপর বসে তাদের ব্যবসা, ঘর সংসার, ঠিকাদারী সাজানোর স্বপ্নে বিভোর। ভাবতেই অবাক লাগে। কি অদ্ভূদ দেশে আমাদের জন্ম, এটি ভাবতেই বিষ্ময় জাগে।

একটি আগ্নেয়গিরি যখন দুরন্ত ভাবে র্কাযক্ষম হয়ে উঠে, উত্তপ্ত লাভা ছড়াতে শুরু করে তখন এটিকে বলা হয় অগ্নোৎপাত। এই আগ্নোৎপাত কখন হতে পারে? বিশাল রোহিঙ্গা শরনার্থী অধ্যুষিত এ এলাকাটির জন জীবনে অগ্নি উদগীরণ কখন শুরু হবে, তার হয়তো দিনক্ষণ বলা যাবে না।তবে আগ্নেয়গিরির জ্বালা মুখে অল্প অল্প ধোঁয়া দেখে যে কেউ বলবে বিপদ আসন্ন।

বেশ কিছু দিন পূর্বে হতেই কথিত এলাকাটিকে বিভিন্ন ভাবে অস্থির জনপদে পরিনত করার লক্ষণ আমরা দেখতে পাচ্ছি। কখনো বৌদ্ধ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, কখনও মানবপাচার, কখনও ইয়াবা সংক্রান্ত অপরাধ এলাকাটিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। বার বার ঝাকিঁ দেওয়া হচ্ছে, ভূমিকম্পের মত, হয়ত এ এলাকার সব কিছুতে কেউ ধস নামাতে চায়। সর্বশেষ রোহিঙ্গা শরনার্থীদের বিশাল সংখ্যা এদেশের অর্থনীতি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবস্থানকে রীতিমত ঝাকিঁ দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে আমরা সব সময় অকারণ আবেগ প্রবন ছিলাম। প্রতিপক্ষ মায়ানমার রোহিঙ্গা জাতিগত নিধনের ক্ষেত্রে কখনও আবেগ প্রবণ হয়ে কোন কাজে হাত দেয় নাই। তারা যা করেছে এবং যা করছে তা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখেই-বাস্তবায়নে তৎপর। তারা যা বলছে তা করছে না। বরং যা বলছে না, তাই অত্যন্ত সু-কৌশলে করে যাচ্ছে।

এখন প্রশ্ন আসছে, মায়ানমারের খুঁটির জোর কোথায়? তাদের পরিকল্পনায় অংশীদার হচ্ছে কারা? শুনেছি চীনের উপর তার নির্ভরতা সবচেয়ে বেশি। এশিয়ায় চীনের অকৃত্রিম বন্ধু রাষ্ট্র কে? চোখ বন্ধ রেখে বলা যায় পাকিস্তান নামের একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রটি বাংলাদেশ নামের ভূখন্ডটির অস্তিত্ব মানসিক ভাবে কখনও মেনে নিতে পারেনি। বরং ৭১ সালের পরাজয়ের জ্বালা তাদের মন মস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন করে রেখেছে বলা যায়।

এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, রোহিঙ্গা জঙ্গী গোষ্ঠীকে সব ধরনের সাহায্য পাকিস্তান রাষ্ট্রটি দিচ্ছে। মায়ানমারের সামরিক ছাউনিতে হামলার পরিকল্পনা ও পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার দেয়া বলে জানা যায়। এ গেল রোহিঙ্গাদের পক্ষে পাকিস্তানের অবস্থান।

অপরদিকে মায়ানমারের রাখাইন বিষয়ক কৌশল নির্ধারণ হয় চীনের সহযোগিতায়। তবে চীনের অকৃত্রিম বন্ধু পাকিস্তান সে ক্ষেত্রে জাতিগত নিধনে চীনের মাধ্যমে মায়ানমারকে যে সহযোগিতা ও পরিকল্পনা তৈরী করে দিচ্ছে না, তা কিভাবে বুঝব? বরং বলতে হয় ‘সর্প হইয়া দংশন কর, ওঁঝা হইয়া ঝাঁড়’।

মূলের দিকে তাকালে আমরা দেখব রাখাইন রাজ্য বা আরাকান রাজ্যটি কখন ও মিয়ানমারের অংশ ছিল না। না ছিল ভারত বর্ষীয় কোন করদ রাজ্য। এটি ছিল রাখাইনদের স্বাধীন একাটি আবাস ভূমি। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে এ রাজ্যটি ইংরেজদের অধিকারে আসে। সংস্কৃতির দিক হতে মুসলিম সভ্যতার অনুগামী ছিলেন রাখাইন রাজগন। বিশাল এ রাজ্যটির পতিত জমি চাষ করার জন্য প্রয়োজনীয় জন শক্তি তাদের ছিল না। তাই রাখাইন রাজগন নির্ভরশীল হয়ে পড়েন পতুর্গীজ জলদস্যুদের উপর। পতুর্গীজ জলদস্যুরা চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, নোয়াখালী, বরিশাল, পটুয়াখালী হতে বাঙ্গালী মুসলমানদের ধরে এনে রাখাইন রাজণ্যদের নিকট বিক্রি করতো। বাঙ্গালী মুসলমানরা রাখাইনে দাস হিসাবে জমিতে চাষাবাদ করতো। বাকীরা দাক্ষিনাত্যের মসুলমান শাহ সুজার সাথে এসে রাখাইনে বসতি তৈরি করে। তারাও দাস হিসাবে অন্তর্ভূক্ত হয়। এরা ছিলেন শাহ সুজার পদাতিক বাহিনীর তীরন্দাজ। এরা “কামানছি” হিসাবে পরিচিত। এদের অর্ধেকই রাখাইন সেনাবাহিনীর অন্তর্ভূক্ত হয়।

রোহিঙ্গা মুসলমারা মূলতঃ রাখাইনে দাস শ্রেণীভুক্তই ছিল। দাস থেকে তাদের মানুষ হিসাবে তৈয়ার করার কোন প্রচেষ্টা কোন কালে কেউ নেয়নি। একটি দাস শ্রেণি আর্থ-সামাজিক সকল সুবিধা হতেই দূরে থাকে। তাই তাদের মধ্যে মনুষ্যত্বের জায়গাটি দখল করে নেয় অসূর। তাদের মধ্যে বিরাজিত ক্ষোভ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে আগ্নেয়গিরির আগ্নোৎপাতের মত বেরিয়ে আসলেও তা সঠিক নেতৃত্ব ও পরিকল্পনার অভাবে কোন কাজে আসেনি। বরং তাদের ভিতর ব্যর্থতার বীজটি রয়ে যাওয়াতে তারা কাকে কখন মেরেছে, কাকে কখন মারবে, তার কোন ইয়াত্তা খুঁজে পাওয়া মুসকিলও বটে। কারণ তারা সব সময় নিজের আদলে কিছুই করেনি। বরং অন্যের পরামর্শে নিজেরা চলেছে ও অন্যেকেও চালাচ্ছে। এ মুহুর্ত্বে রোহিঙ্গারা ধীর সুস্থে পথের ক্লান্তি এবং রোগ শোক সারিয়ে অনেকটুকু সাবলীল হয়ে উঠছে। রোহিঙ্গারা ক্রমশ আতঙ্ক কাটিয়ে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে অস্থিরতার বদল তৈরী হচ্ছে এক ধরনের মানসিক স্বস্তি। ঠিক এই সময়ে মানুষ তার কর্ম পরিকল্পনা তৈয়ার করে নিতে চায়। রোহিঙ্গারা ক্রমশ সংঘবদ্ধ হবে-তাতে কোন সন্দেহ নেই। দাস মানসিকতার এই সমস্ত রোহিঙ্গারা এর মধ্যেই ক্যাম্পে অনেক ঘটনার জন্ম দিয়েছে এবং দিচ্ছে।

বন্যার জলের মত আসছে বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা। কার উদ্দেশ্য কি তা বিশ্লেষণ করা দূরূহও বটে। একটি দাতা সংস্থার সাথে অন্যটির কাজের মিল নেই। প্রতিনিয়ত মসজিদ মাদ্রাসা করার নামে রোহিঙ্গাদের মাঝে মিশে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে অসংখ্য ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠান। বন্ধুত্বের সেতু বন্ধন তৈরীর প্রচেষ্টা চলছে প্রতিনিয়ত। ক্যাম্পে রাত কাটানো সহ রোহিঙ্গাদের সাথে অহরহ সর্ম্পক তৈরীর পায়তারা আমরা দেখছি। কোন এক সময় দাতার বেশে আসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যাক্তি রোহিঙ্গাদের বশে এনে যদি একটি জঘন্যতম কান্ড ঘটিয়ে বসে তবে আশ্চর্য হবার তেমন কিছুই থাকবে না। অথবা পাশ্ববর্তী এলাকার জনসাধারণের সাথে যদি কোন হাঙ্গামা তৈরী হয়ে যায়, তবে তা দ্রæত মহামারী আকারের রূপ নিতে পারে বলেই মনে হয়। এলাকার পর এলাকা রোহিঙ্গাদের পদভারে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠা অসম্ভব নয়।

জানা যায় মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক অধিকাংশ এনজিও, যারা গত বিএনপি আমলে জামাত বিএনপির সাথে পরামর্শক্রমে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করতো, তারা এবারের রোহিঙ্গা সংকট কালীন পরিস্থিতিতে সে আগের মতই জামাত বিএনপির সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। জামাত শিবিরের ক্যাডাররাই মূলত সেই সমস্ত এনজিওকে যৌক্তিক পন্থায় দূর ও কাছ থেকে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে ও নতুন এনজিও কর্মী সৃজনে সাহায্য করছে। এখানে উল্লেখ্য যে, তাদের পরামর্শেই ইউএনএইচসিআর, আইওএম, এমএসএফ তাদের গাইড ও অনুবাদক হিসাবে ইংরেজি জানা রোহিঙ্গা তরুণদের কে নিয়োগ দিচ্ছে। এদের কর্মকান্ড যে কোন সময় রোহিঙ্গা সংকট সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করার সংগত কারণ রয়েছে। এরাই মূলত এক ক্যাম্পের সাথে অন্য ক্যাম্পের তরুণদের যোগাযোগ ঘটিয়ে দিচ্ছে। এই যোগাযোগ অচিরেই ভিন্ন দিকে মোড় নিবে বলেই ওয়াকিবহাল মহল ধারনা করছে। সংঘবদ্ধ রোহিঙ্গা যুবকরা যেকোন মুহুর্তে সরকারের যেকোন নির্দেশনা যদি তাদের মনপূত না হয় তা তারা সংখ্যার জোড়ে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। রোহিঙ্গাদের সংঘবদ্ধতা এ এলাকার জন্য মারাত্বক পরিণতি ডেকে আনতে পারে বলে ওয়াকিবহাল মহল ধারণা করছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলি সামরিক আধা সামরিক ও পুলিশ দ্বারা কতটুকু নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে? তাও বিশ্লেষণ করে দেখার দরকার আছে বলে মনে করি। তাই………..
১. অতি সত্বর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠিকে একটি নিয়ন্ত্রিত বেষ্টনীর মধ্যে আনা প্রয়োজন।
২. আগত সকল ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠান যে সমস্ত ত্রাণ সামগ্রী ও অর্থ আনছে তা সরকারী কোষাগারে রাখা। কোন ত্রাণ সামগ্রী যে কোন ব্যাক্তি বিশেষ কিংবা প্রতিষ্ঠানের ইচ্ছেমত দিতে না পারে তার ব্যবস্থা নেয়া। দাতাগণ উপযুক্ত রসিদ পাবেন মাত্র। উল্লেখ্য যে, আগত ব্যাক্তিগন ও প্রতিষ্ঠান চেক পোষ্ট থেকে বিদায় নিবেন।
৩. সামরিক, আধা সামরিক ও পুলিশের শক্তিবৃদ্ধি সহ অবাধ নিয়ন্ত্রণ তৈয়ার করা।
৪. শরনার্থীদেরকে বিভিন্ন সংখ্যায় বিভক্ত করে ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র তৈয়ার করতে হবে। সাপ্তাহিক কিংবা দৈনিক হারে সামরিক বাহিনীর ব্যবস্থাপনায় ত্রাণ বিতরণ (আইডি কার্ড প্রদশন সাপেক্ষে) করা প্রয়োজন। অধিক সংখ্যক ত্রাণ কেন্দ্র প্রয়োজন।
৫. যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গাদেরকে আলাদা-আলাদা স্থানে সরিয়ে নেয়া প্রয়োজন। মোবাইল এবং অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমে হতে রোহিঙ্গাদের কে দূরে রাখতে হবে।
৬. সর্বক্ষেত্রে আবেগ পরিহার করতে হবে।
৭. নজরদারী আরো বেশী হওয়া প্রয়োজন।
৮. রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থা গ্রহণ।
৯. অ-অনুমোদিত ব্যাক্তিদের ক্যাম্প এলাকায় প্রবেশ করতে না দেয়া।
১০. মহিলা তাবলীগ ও মিশানারীর বিষয়ে সার্বিক সতকর্তা বৃদ্ধি জরুরী।
১১. রোহিঙ্গাদেরকে দ্রুত বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প করে সরিয়ে নিতে হবে । নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার ব্যবস্থা জরুরী। তাদেরকে বিভক্ত করে ফেলা জরুরী।
১২. প্রফেসর ডঃ ওয়াকার উদ্দিন, ইউএসএ তে বসবাসরত রোহিঙ্গা শিক্ষাবিদ, Geneva Council-এ তিনি রোহিঙ্গা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেন। তার ব্যাপারে সংবাদ নেয়া জরুরী। তিনি The Pennsylvania State University at University Park-কর্মরত আছেন। তিনি রোহিঙ্গাদের অঘোষিত নেতা।
১৩. স্থানীয় বিকাশ (Bkash) ও যাবতীয় স্থানীয় ব্যাংক লেনদেনের বিষয়ে সংবাদ নেয়া প্রয়োজন।
১৪. যে সমস্ত দাতা ক্যাম্পে কাজ করছে তাদের সংগৃহিত অর্থের উৎস সম্পর্কে সুনিশ্চিত হওয়া।
১৫. NGO গুলোর সংখ্যা এক-চর্তুাংশ ভাগে কমিয়ে আনা জারুরী। স্থানীয় NGO গুলি লুটপাটের পসরা সাজাবে তাতে সন্দেহ নাই। তাদের সংগৃহিত অর্থের ব্যবহার কি ভাবে হচ্ছে তা নজরদারীতে আনা প্রয়োজন।


লেখক :


আদিল চৌধুরী, আজীবন সদস্য, বাংলা একাডেমী,ঢাকা।